নাজুক রক্ষণব্যূহ নিয়ে হামলা করতে গেলে পাল্টাহামলায় রক্তাক্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। প্রতিপক্ষ এর সুযোগ নিতে শুরু করলেই রণসজ্জার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি আর ফাঁক-ফোকরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি যেমন প্রকাশ্য করে দিয়েছে যে চেনা কন্ডিশনের সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্পিনাররা যতই দক্ষ হন না কেন, একই ধরনের বোলিং সামলানোয় বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা মোটেও তা নন। বরং নিজেদের পাতা ঘূর্ণিফাঁদ যে কখনো কখনো উল্টো গলার ফাঁসও হয়ে উঠতে পারে, এজাজ প্যাটেলের বাঁহাতি স্পিন আর কোল ম্যাকনকির অফস্পিনের যুগলবন্দি তা প্রমাণও করেছে। এমন নয় যে নিজেদের মাঠে প্রতিপক্ষের স্পিনে নাকাল হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।

স্পিন সামলানোয় ব্যাটসম্যানদের অদক্ষতার নজির আছে আরো। সেটি কি টেস্ট, কি ওয়ানডেতেও! সেসবের কিছু কিছু বড় সাফল্যের আড়াল নিয়ে চোখ এড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ সালে দেশের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটি আসতে বাধ্য। ধীরগতির টার্নিং উইকেটে ঢাকায় প্রথম ম্যাচ জিতে ক্রিকেট বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেওয়া বাংলাদেশকে কিন্তু সিরিজ জিততে দেননি দুর্ধর্ষ নাথান লায়ন। চট্টগ্রামে জিতে সিরিজে সমতা ফেরানোর ম্যাচে এই অফস্পিনার নিয়েছিলেন স্বাগতিকদের ২০ উইকেটের ১৩টিই। দুই ম্যাচের সিরিজে ২২ উইকেট নেওয়া লায়নের মতো উঁচুদরের স্পিনার অবশ্যই নন এজাজ-ম্যাকনকিরা।

অথচ কার্যকারিতা আর অভিজ্ঞতায় যোজন যোজন পিছিয়ে থাকা এই স্পিনাররাও যে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের স্পিন-দুর্বলতা উন্মোচন করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, এবার কুড়ি-বিশের ম্যাচেও তা প্রমাণিত। দলের কাছের এবং দূরের মতো শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারেই এসে পৌঁছাচ্ছে। দলসংশ্লিষ্ট একজন যেমন তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে হারের ময়নাতদন্তে স্পিনের বিপক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাটিংকেই দাঁড় করালেন কাঠগড়ায়, ‘সত্যি কথা বললে, আমরা স্পিন ভালো খেলি না। এটি নতুন নয় অবশ্য। ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখেছি বেশির ভাগ উইকেট স্পিনাররাই পায়। সব সময় হয়তো এই দুর্বলতা চোখে পড়ে না।’

আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ স্কোয়াডের কাউকে ছাড়াই এই সফরে আসা নিউজিল্যান্ড খর্বশক্তির বলেই পুরনো রোগের সংক্রমণ এবার দৃষ্টি কাড়ছে বেশি। বহুদিন হয় বিসিবির চাকরি ছেড়ে বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা হিসেবে থিতু হওয়া নাজমুল আবেদীন ফাহিমেরও অভিন্ন মত। সিরিজের তৃতীয় টি-টোয়েন্টি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্পিন খেলার সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁর ভাষ্য, ‘অবশ্যই। আমাদের ব্যাটসম্যানরা আগেও কিন্তু স্পিনে অনেক সময় ভুগেছে। দেখা গেছে, পেস ভালো সামলে দিয়েছে, কিন্তু স্পিনে বিপর্যয় নেমে এসেছে।’ অস্ট্রেলিয়া সিরিজ থেকে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে যে রকম উইকেটে খেলা হয়ে আসছে, তাতে স্বাগতিকদের সঙ্গে ব্যবধানও কিউইরা কমিয়ে এনেছে বলে মনে হয়েছে এই ক্রিকেট কোচের, ‘এই উইকেটে বিদেশিরা যেমন, আমরাও তেমনই (স্পিন খেলার ক্ষেত্রে)।

যে পার্থক্যটি ছিল, তা আস্তে আস্তে কমে আসছে।’ মিরপুরের উইকেটের বর্তমান চরিত্র মাহমুদ উল্লাহর দলের ব্যাটিংয়ে বাড়তি চ্যালেঞ্জও যোগ করেছে বলে মনে হয়েছে সাকিব আল হাসানের ‘ক্রিকেট গুরু’র, ‘এখন যে রকম উইকেটে খেলা হচ্ছে, সেখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। এমনিতে আমরা যেটি দেখি, আমাদের দেশে ধীরগতির উইকেটে বল নিচু হয়। পাশাপাশি এবারের উইকেটে অসমান বাউন্সও আছে। এত কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আসলে মুশকিলই।’ সিরিজ জেতাও এখন বড্ড কঠিন হবে বলে মত ফাহিমের, ‘আরেকটি বড় দুর্বলতাও আমাদের বেরিয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি আমরা নিজেরা কমফোর্ট জোনে ছিলাম, চেয়েছি প্রতিপক্ষকে এর বাইরে রাখতে। হোম কন্ডিশনের সুবিধা নেব ভেবে মানসিকভাবেও আমরা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সহজে ম্যাচ জিতছি বলে আমাদের তেমন গা-ঝাড়াও দিতে হয়নি, যা অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে এক রকম। তাই পাল্টা আঘাত যখন এসেছে, তখন হকচকিয়ে গেছে। না হলে এত খারাপ ব্যাটিং (তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে) তো করার কথা নয়।’ স্পিন সামলানোর দুর্বলতায় পাল্টাহামলার যে পথ খুলে রেখেছিল স্বাগতিকরাই!